আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড (IMO) এর ৬৪তম আসরে অংশ নিতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ গণিত দল এর ৬ জন খুদে গণিতবিদ জাপানে অবস্থান করছে। এবারের আসর নিয়ে মোট ১৯তম বারের মতো বাংলাদেশ এই আয়োজনে অংশগ্রহণ করছে। ৭ জুলাই জাপানের চিবা শহরে উদ্বোধনী পর্বের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এবারের আইএমও ২০২৩ এর যাত্রা। ৮ এবং ৯ জুলাই, এ দুই দিনব্যাপী মোট নয় ঘন্টার পরীক্ষাতে বাংলাদেশসহ শতাধিক দেশের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেছে। আগামী ১২ জুলাই সমাপনী পর্বের মাধ্যমে শেষ হবে এবারের আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড ২০২৩।
আইএমও (IMO) প্রতিযোগিতার পরীক্ষাকে পৃথিবীর অন্যতম কঠিন পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই প্রতিযোগিতায় প্রতিদিন ৩টি করে দুইদিনে মোট ৬টি গাণিতিক সমস্যা দেয়া হয় যা একেবারেই নতুন, কোন বইতে এ সমস্যাগুলো পাওয়া যায় না, কোন শিক্ষার্থী এর আগে এগুলো সমাধানও করেনি। প্রতিদিন তিনটি সমস্যা সমাধান করার জন্য সময় থাকে সাড়ে চার ঘন্টা, দুইদিনে মোট নয় ঘন্টা! সমস্যাগুলো সাধারণত অংশগ্রহণকারী দেশের দলনেতার মাধ্যমে আইএমও কমিটির কাছে পাঠানো হয়, সেখান থেকে বিভিন্ন যাচাই-বাছাইয়ের পর মূল প্রতিযোগিতার জন্য প্রশ্ন নির্বাচন করা হয়। বীজগণিত (Algebra), সংখ্যাতত্ত্ব (Number Theory), গণনাতত্ত্ব (Combinatorics), জ্যামিতি (Geometry) ইত্যাদি টপিক থেকে বেশিরভাগ প্রশ্ন করা হয়ে থাকে।
এবারের বাংলাদেশ দলে মোট ৬ জন উদীয়মান গণিতবিদ আছে। এদের মধ্যে মাত্র ২ জন শিক্ষার্থীর আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। সে বিচারে এবারের দলটা নতুনই বলা চলে। বাংলাদেশ দলের ছয় জন শিক্ষার্থী হলো- ঢাকা কলেজর এস এম এ নাহিয়ান, রংপুরের আরসিসিআই পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শাহরিয়ার হোসেন, ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নুজহাত আহমেদ দিশা, চট্টগ্রামের ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের জিতেন্দ্র বড়ুয়া, ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের দেবপ্রিয় সাহা রায় এবং কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ইমাদ উদ্দীন আহমাদ হাসিন।
এই ছয় জন শিক্ষার্থীর মধ্যে এস এম এ নাহিয়ান এবং নুজহাত আহমেদ দিশা বিগত কয়েক বছর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণিত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে এবং সাফল্য পেয়েছে। নাহিয়ান এবং দিশা দুইজনই বিগত বছরগুলোতে ইরানিয়ান জিওমেট্রি অলিম্পিয়াড (IGO), ইরানিয়ান কম্বিনেটরিক্স অলিম্পিয়াড(ICO), এশিয়া প্যাসিফিক ম্যাথ অলিম্পিয়াডে (APMO) যথাক্রমে রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে এই দুইজনই বিগত বছরে সম্মানজনক স্বীকৃতি পেয়েছে (বি. দ্র. আইএমওতে অন্তত একটি সমস্যা পূর্ণাঙ্গভাবে সমাধান করতে পারলে সম্মানজনক স্বীকৃতি বা Honorable Mention পাওয়া যায়)। নুজহাত আহমেদ দিশা গত তিন বছর ইউরোপিয়ান গার্লস ম্যাথ অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে ২টি রৌপ্য এবং ১ ব্রোঞ্জ পদক লাভ করে। দলের অন্য সদস্য জিতেন্দ্র বড়ুয়া এবং ইমাদ উদ্দীন আহমাদ হাসিন ২০২২ সালের ইরানিয়ান জিওমেট্রি অলিম্পিয়াডে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেছে। বাকি শিক্ষার্থীরাও বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্বে বিজয়ী হয়ে এবং গণিত ক্যাম্পের পরীক্ষাগুলোতে ভালো ফলাফল করে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে দলে জায়গা করে নিয়েছে।
বাংলাদেশ গণিত দলের সদস্য নির্বাচনের প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ। এ বছর সারা বাংলাদেশের প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থী গণিত উৎসবে অংশ নেয়। বাছাই পর্ব এবং বিভাগীয় পর্ব পার হয়ে প্রায় ১০০০ জন শিক্ষার্থী জাতীয় পর্বে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এরপর ১০০ এর কম শিক্ষার্থীকে জাতীয় পর্যায়ে পুরষ্কৃত করা হয়, সেখান থেকে বাছাইকৃতদের নিয়ে শুরু হয় জাতীয় গণিত ক্যাম্প। পাশাপাশি জাতীয় প্রাইমারি এবং জুনিয়র ক্যাম্পও অনুষ্ঠিত হয়। ক্যাম্প চলাকালীন বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা, এশিয়া প্যাসিফিক ম্যাথমেটিক্যাল অলিম্পিয়াড এবং আইএমও নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ছয় জন শিক্ষার্থীকে গণিত দলের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের সদস্যপদ পেয়েছে এবং ২০০৫ সাল থেকে নিয়মিত এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। ২০০৯ সালে প্রথম ব্রোঞ্জ পদক, ২০১২ সালে প্রথম রৌপ্য পদক, ২০১৮ সালে প্রথম স্বর্ণপদক সহ এখন পর্যন্ত আইএমওতে ১টি স্বর্ণ, ৭টি রৌপ্য, ৩২টি ব্রোঞ্জ পদক এবং ৩৮টি সম্মানজনক স্বীকৃতি লাভ করেছে বাংলাদেশ।
আশা করি বরাবরের মতো এবারও বাংলাদেশের গণিত দল ভালো করবে, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পতাকা আরো একবার সগৌরবে উড়তে থাকবে। পুরো টিমের প্রতি অশেষ শুভকামনা রইলো।
গণিত অলিম্পিয়াড সংক্রান্ত বিভিন্ন আপডেটের জন্য গণিত অলিম্পিয়াডের ফেসবুক পেইজ (https://facebook.com/BdMOC), এবং ফেসবুক গ্রুপ ( https://facebook.com/groups/BdMOC) দেখা যেতে পারে। এছাড়া বাংলার ম্যাথের ওয়েবসাইটেও নিয়মিত আপডেট থাকবে।
(গণিত অলিম্পিয়াড সিরিজের অন্যান্য লিখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।)